হালিমুন্নেছা চৌধুরানী মেমোরিয়াল বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নীনা এগিয়ে চলা নারী সমাজের উদাহরণ
থেমে না গিয়ে বাঁধা অতিক্রম করে এগিয়ে চলা নারী সমাজের উদাহরণ আনোয়ারা নিনা। শিক্ষা ও চাকুরীর ক্ষেত্রে ব্যক্তি সাফল্য অর্জন করতে পেরেছেন তিনি। ভালুকা উপজেলার ধীতপুর ইউনিয়নের ধলিয়া গ্রামের ব্যাংক কর্মকর্তা মো: নজমুল হক খানের স্ত্রী ও হালিমুন্নেছা চৌধুরানী মেমোরিয়াল বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আনোয়ারা নিনা। তিনি উপজেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক নির্বাচিত হয়েছেন একাধারে ৬ বার।
উপজেলার বিরুনিয়া ইউনিয়নের মাহমুদপুর গ্রামের মো: আনোয়ার এলাহী ও আকিমন এলাহীর ৫ মেয়ে ও ১ ছেলের মধ্যে ২য় সন্তান আনোয়ারা নিনা । কথা হয় আনোয়ারা নিনার সাথে, জানাযায় শিক্ষা ও চাকুরীর ক্ষেত্রে তার সফলতার গল্প।
তিনি বলেন, ছাত্র জীবনে বিদ্যালয়ের মেধা তালিকায় ১ম/২য় স্থান অধিকার করি। ইচ্ছে ছিল বড় হয়ে ডাক্তার হবো। কিন্তু যখন অষ্টম শ্রেণীর ফাইনাল পরীক্ষা দেই, প্রতিবেশীরা আমার বিয়ের জন্য প্রস্তাব নিয়ে আসতে শুরু করে।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে গ্রামের সমাজব্যবস্থা ছিল অনেক বেশি রক্ষণশীল। পরিবারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গিয়ে ‘না’ বলাটা ছিল মেয়েদের জন্য অকল্পনীয়।
ছোট বোনের কাছ থেকে শুনতে পাই আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। শুনে আমি বিস্মিত, হতবাকও। কাউকে কিছু বলতেও পারছিলাম না। তখন ছিল মেনে নেওয়ার সংস্কৃতি। পরীক্ষা শেষে বিয়ের পিঁড়িতে বসে পড়াশুনার শেষ করার শপথ নিয়েছিলাম, কিন্তু সেই মনোবাসনা পূরণ হয়নি, বিয়ে আমাকে করতেই হলো।
স্বামীকে বললাম আমার ইচ্ছের কথা, তিনি সায় দিলেন। ভুলে গেলাম থেমে যাওয়ার দুঃস্বপ্ন। এরপর ১৯৮৪ সালে ধলিয়া আজিমুন্নেসা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ করি। এইচএসসিতে ভর্তি হই ভালুকা ডিগ্রি কলেজে। শ্বশুর বাড়ি থেকে কলেজ ছিল প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে। যাতায়াতের সুবিধা না থাকায় প্রায়ই কলেজে যেতে অসুবিধায় পড়তে হতো।
আমার অসুবিধার কথা চিন্তা করে আমার স্বামী ভালুকা উপজেলা শহরে বাসা ভাড়া নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু আমার শ্বশুর-শ্বাশুরীর বাঁধার মুখে পড়তে হয়। আমার প্রবল আগ্রহের কাছে তারা মেনে নেয়। তারপর আর থামিনি। ১৯৮৬ সালে এইচএসসি পাশ করি। সংসারের বিভিন্ন চাপে মেডিকেল পড়ার জন্য নিজেকে আর তৈরি করতে পারিনি। এরপর নাসিরাবাদ কলেজ থেকে ডিগ্রি (পাস কোর্স) শেষ করে আনন্দমোহন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে সাধারণ ইতিহাসে মাস্টার্স ও উত্তরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলাম শিক্ষায় মাস্টার্স শেষ করি।
এরপর শুরু হয় কর্মজীবন। নবনির্মিত প্রতিষ্ঠান হালিমুন্নেছা চৌধুরানী মেমোরিয়াল বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করি। শুন্য হাতে প্রধান শিক্ষকের গুরু দায়িত্ব গ্রহন করে প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলায় নিবিষ্ট হই। সত্য কথা বলতে তার কোন সংকোচ নেই। যে, সেই বেড়া দরজা বিহীন টিনের ঘর সমৃদ্ধ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠান প্রধান হিসেবে বিদ্যালয় পরিচালনার অভিজ্ঞতা ও প্রশাসনিক দক্ষতা ছিল হালকা টিনের মতই লঘু। সুদীর্ঘ ২০ বছরে আমি আমার ক্যারিয়ারে অর্জন করেছি বিচিত্র অভিজ্ঞতা আয়ত্ব করতে সক্ষম হয়েছি। ধৈর্য্য, দৃঢ় সংকল্পবোধ, অধ্যাবসায় আর কঠোর পরিশ্রম। আর এ কারনেই তথা বিদ্যালয়টি আজ বিভিন্ন বিষয়ের শ্রেষ্ঠত্বের দাবীদার।
বিদ্যালয় পরিচলনায় যেসব পদক্ষেপগুলো নিয়েছি বার্ষিক কর্মপরিকল্পনা, ইন হাউস প্রশিক্ষন, শিক্ষক ডায়রী ব্যবহার, রুটিন মাফিক ক্লাস নিশ্চিতকরণ, বার্ষিক ম্যাগাজিন, দেওয়াল পত্রিকা, জাতীয় দিবস সমুহ উৎযাপন, বার্ষিক ক্রিড়া, সহপাঠ্যক্রম নিশ্চিত করণ, পাঠাভ্যাস কর্মসুচি, বির্তক প্রতিযোগিতা, বিজ্ঞান ও তথ্য প্রযুক্তি মেলা, স্কাউট টিম গঠনসহ আরও বিভিন্ন উদ্যোগ। বর্তমানে আমার বিদ্যালয়ে প্রায় ১২শ ছাত্রী রয়েছে। স্কাউটে আমার বিদ্যালয় থেকে পেয়েছে প্রেসিডেন্ট পুরষ্কার।
আমার একটি মাত্র মেয়ে সন্তান। কমিউনিটি বেজড মেডিকেল কলেজ ভর্তি করিয়েছি। নিজের স্বপ্নটা মেয়েকে দিয়ে পূরণ করার চেষ্টা করছি। জীবনের সাফল্যের যাত্রায় স্বামী ও নিজের মা, শ্বশুর-শাশুড়ির সহযোগিতার কথা কৃতজ্ঞতাভরে স্মরণ করেন এ নারী।
যেকোনো কাজে সফলতার জন্য যোগ্যতা আর দক্ষতার বিকল্প নেই। আমরা প্রত্যেকেই আগামী দিনের একটি সুন্দর জীবনের স্বপ্ন দেখি। স্বপ্ন দেখি দক্ষতা, যোগ্যতা আর সততায় পরিপূর্ণ সুন্দর একটি সমাজ বিনির্মাণের। এ ক্ষেত্রে একটি সফল জীবন এবং সুন্দর সমাজ গঠনের জন্য কারিগরদের প্রয়োজন সর্বক্ষেত্রে যোগ্যতা, দক্ষতা আর ভারসাম্যপূর্ণ জীবন গঠনের অর্থাৎ একটি শাণিত ক্যারিয়ার গঠনের।